উজান আসলে আমার আব্বু-আম্মুর সন্তান!
এটা ঠিক, উজানকে আমি গর্ভে ধরেছি, আমার আর সুজনের ডিম্বানু-শুক্রানু থেকেই ওর জন্ম। কিন্তু যেভাবে আমার আব্বু-আম্মুর কাছে ও বড় হচ্ছে, যেভাবে ওর সব অনুভূতি, না বলা কথা ওরা বোঝেন, তাতে নিজেকে শুধু বায়োলজিক্যাল মাদারই মনে হয় আমার।
আমার আব্বুর খুব ছেলের শখ ছিল। কিন্তু তার মানে এইটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, মেয়ে বলে নিদারুন অবহেলায় আমাদের দিন কেটেছে। আমরা রাজত্ব করেই দিন কাটিয়েছি। তবে ওই যে, থাকে না, প্রথাগত বাঙালী বাবার মন। যদিও সেইভাবে বিষয়টা কখনো প্রকাশ করেনি, কিন্তু আমরা বুঝতাম।
আমার মেয়ে বাচ্চার এতো শখ ছিল, কিন্তু আব্বুর তীব্র ইচ্ছার কাছে সম্ভবত আমার ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে আল্লাহ উজানকে দিয়ে দিলেন আমার কোলে। এমনই ওয়ারার গর্ভেও এলো ধ্রুব।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আব্বুর ছেলে সন্তানের আকাংখাই প্রকৃতি আমাদের দুই বোনের ভেতর দিয়ে পূরণ করেছে।
উজান যখন হলো তখন আব্বুর বয়স ৬৭ বছর। গত ৬৭ বছরে যে কাজ কোনোদিন করেনি, সেইসব কাজই তিনি করা শুরু করলেন। যেমন ধরেন, উজানের হাগু হিসু পরিস্কার করা, ডায়াবার বদল, ওকে গোসল করানো, সারা শরীরে লোশন মাখানো, পোশাক পরিবর্তন, ঘুম পাড়ানো, প্রয়োজনে খাইয়েও দেওয়া!
যারা আমার আব্বুকে চেনেন, তারা জানেন এগুলো তার জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ এর কাজ। তাকে ডায়াপার বদলাতে দেখা কতটা অবিশ্বাস্য!
বন কর্মকর্তা শেখ আব্দুল মাবুদকে দেখলে দুনিয়ার সব বাচ্চা ভয় পেত। গায়ের রঙ, শারীরিক গড়ন, বাজখাঁই গলা আর ভয়ঙ্কর মেজাজই এর কারণ। পরিবারের কোনো বাচ্চা তার আশপাশে ভিড়তো না। এমন ঘটনাও আছে যে, দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি বনে আব্বুকে সামনে দেখে এক কাঠচোর কাপড় চোপড় ভিজিয়েছিল।
তো আমার সেই দশাসই আব্বু এখন উজানের কাছে ধরাশায়ী। যে কোনো পরিচয়ের চেয়ে এখন উজান-ধ্রুব’র নানা পরিচয়েই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। সারাদিন নানুভাই নানুভাই করে করে অস্থির।
স্নেহ যে নিম্নগামী সেইটার সরাসরি প্রমাণ পেতে আপনাকে আমাদের বাসায় আসতে হবে। যেই বাসার কর্তাব্যক্তি নানা হওয়ার পর প্রথম জানলেন যে, বাচ্চা পালন বেশ কঠিন কাজ। কারণ নিজের দুই সন্তানের বেলায় তাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। তার সুপার উইমেন স্ত্রী গৃহসহকারীদের নিয়েই সব দু’হাতে সামলেছেন (তার খেসারত অবশ্য এই বয়সে এসে বেশ ভালোই দিতে হচ্ছে)।
উজান অন্য সবার চেয়ে দেরিতে হাঁটা শিখেছে। কারণ তার নানা তাকে মাটিতে নামতে দিত না। ব্যাথা পাবে, ঠান্ডা লাগবে, খোঁচা খাবে ইত্যাদি নানা অজুহাতে তাকে বিছানায় নিয়ে বসে থাকতো আব্বু। ফলাফল হিসেবে ১৬ মাস লেগেছে তার হাঁটতে। এমনই আহ্লাদ।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এখন উজান দুষ্টুমি করলে আব্বু বকা দিলেও সে পাত্তা দেয় না। সেটা হয়েছে আরেক বিপদ।
আজ ৬৯ বছরে পা দিল উজান-ধ্রুব’র নানা। আমার সাথে আব্বুর ভীষণ অমিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় মিলটা হলো, আমাদের দুজনেরই ভয়াবহ রাগ। হুট করে রেগে যাই। সারাদিন আব্বুর সঙ্গে ঝগড়া করি, সেগুলো কোনো আহ্লাদের ঝগড়া না, সিরিয়াস ঝগড়া। মাঝে মাঝেই আব্বুর ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা হয় আমার। কথা বলতে ইচ্ছা হয় না।
কিন্তু দিনশেষে মাথা ঠান্ডা হলে অনুশোচনা হয়। এই যে ৬৯ বছর বয়সে এসেও হাসিমুখে আমার ছেলের সব অত্যাচার মেনে নিচ্ছে তার কী কোনো প্রতিদান হয়? আমি দুই দুইবার এইচএসসিতে ফেল করার পর ভেবেছিলাম অন্যকিছু করবো, ডিপ্লোমা পড়বো। সবাই বলতো বিয়ে দিয়ে দিতে। শুধু আব্বু এসে আমাকে বলেছে, ‘তুই পড়, আমি এর শেষ দেখতে চাই।’ এর কী কোনো প্রতিদান হয়?
আজকাল মাঝে মাঝে আব্বু আফসোস করে, উজান-ধ্রুব বড় হয়ে কেমন হবে সেটা সে দেখতে পারবে না। আব্বু জানে না, এই কথা শুনলে আমার বুকের ভেতর খচ করে ওঠে। আব্বু থাকবে না, সেটা তো কখনো ভাবিনি। আব্বু ছাড়া জীবন কেমন হয় সেটা তো জানি না। তাহলে?
প্রতিবছর আব্বুর জন্মদিন আসলে ভাবি, সামনের বছরটাও যেন তাকে পাই। দিন যত যাচ্ছে, এই চাওয়া ততই বাড়ছে। বুকের ভেতর ভয়ের চাপটাও বাড়ছে।
শুভ জন্মদিন আব্বু। শুভ জন্মদিন উজান-ধ্রুব’র নানা। রাগ কমাও, জেদ কমাও আর তুমিই সব বোঝো এইটা ভাবা বন্ধ করো।
সবশেষে একটাই কথা, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা (হে আমার রব, আমার পিতামাতা উভয়কে রহম কর, যেমনিভাবে তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন পালন করেছেন)।