ওড়না, নারীবাদ আর নিজেকে বোঝার এক ছত্র

নীরার খেরোখাতা | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ২:৩১ ...

গত কয়েকদিন ধরেই বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। ভেবে ভেবে কোনো কূল কিনারায় পৌঁছতে পারি না। মধ্যবয়সে এসে বেশ ডিলেমায় ভুগি। আমি কেমন ছিলাম আর কেমন হয়েছি, কোনটা আসল আমি, কেমন জীবন চাই এসব নিয়ে নিজের মধ্যেই টানাপোড়েন চলে দিনরাত।

নারীবাদের সাথে আমার পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান পড়ার সময়। তখন কতটুকু বুঝেছি বা ধারণ করেছি জানি না। তবে এর বহু আগ থেকে, অন্তত অষ্টম-নবম শ্রেণি থেকে আসলে আমি নিজের ভেতর পরিবর্তন টের পেয়েছি। ছেলে-মেয়ে সমান অধিকার, ছেলেরাও স্রেফ বন্ধু হতে পারে, ছেলেবন্ধুর হাত ধরে হাঁটা যায়, মেয়েরাও চাইলে একাই অনেক কিছু করতে পারে এই বোধগুলো আমার সেসময়ই তৈরি হচ্ছিল। তবে পাশে কোনো মেন্টর পাইনি, বা সেরকম পড়ালেখার উপাদান পাইনি বলে হয়ত বিষয়গুলো তেমন প্রকাশ পায়নি। তবে আমার পরিচিতজনেরাই জানেন যে, আমি আমার বয়সী অন্যদের চাইতে বোল্ড ছিলাম, অন্তত আমি যে সার্কেলে মিশতাম তার প্রেক্ষাপটে। আমার ভেতর ভীষণ নেতৃত্বের গুণ ছিল।

তবে এটাও ঠিক, ওই বয়সে আমি বিপুল বডি শেমিং এর শিকার হয়েছি, আমি মোটা তাই বিয়ে হবে না, বিয়ে হবে না, বিয়ে হবে না বলে লোকজন কান ঝালাপালা করেছে। তখন পর্যন্ত আমি ভাবতাম, বিয়েই বুঝি শেষ গন্তব্য। প্রেমই বুঝি একমাত্র আরাধ্য।

আমার এসব ভাবনায় দারুণ পরিবর্তন আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে ভর্তির পর। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সমাজের সংস্কৃতি জানার পর আমি বুঝতে পারি আমার মনোজগতে পরিবর্তন আসছে। কিন্তু তবু আমি যেহেতু একটা সমাজের অংশ ছিলাম, তাই পরিবর্তনটা দেখানোর সুযোগ ছিল না।

কয়েক বছর আগ পর্যন্তও আমি যথেষ্ট জাজমেন্টাল ছিলাম। মানুষের কথায় প্রভাবিত হতাম, ভালো মেয়ে হতে চাইতাম। তবে আমি নিজেকে বাংলাদেশের একদম টিপিক্যাল মিডলক্লাস পরিবারের সদস্য বলতে পারি না। কারণ, আমার আম্মু একটা সময় পর্যন্ত দারুণ প্রগ্রেসিভ ছিল। ছেলে-মেয়েতে যে কোনো পার্থক্য নেই, সেই প্রাথমিক পাঠ তার কাছ থেকেই পাওয়া। গান, ছবি আঁকা, কারাতে এসব তার উৎসাহতেই শিখেছি। মোটা হওয়ার কারণে আমি একসময় লুকিয়ে থাকতে চাইতাম, আম্মু আমাকে প্রকাশ্য হতে বাধ্য করত। এমনকি আমি যখন দফায় দফায় উচ্চ মাধ্যমিকে গাড্ডা মারছি, তখনও আব্বু আম্মু বিপুল উৎসাহে আমাকে পরীক্ষা দেওয়াচ্ছে। অন্তত সে সময় বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। আমি প্রচুর আউটবই পড়তাম, মানে পড়ার অনুমতি ছিল। গল্পের বই পড়াকে কখনোই আমার বাসায় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়নি, গল্পের বই কেনাকে অপচয় বলেও মনে করা হয়নি।

তবু আমরা যেহেতু এই সমাজের মানুষ, সেহেতু ভালো মেয়ে হওয়ার একটা অঘোষিত চাপ ছিল। যেমন ওড়না বা কটি পরা, সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফেরা, ঘর গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি। 

বলাই বাহুল্য, ভালো মেয়ে হওয়ার বেশিরভাগ পরীক্ষাতেই আমি সম্ভবত ফেল করেছি। কেবল ওড়না পরাটা এখনো ধরে রেখেছি। প্রচণ্ড গরমে একটা ছেলে যখন ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে বাইরে যায়, তখন অন্তর্বাস, তার ওপর কামিজ, কামিজ পাতলা হলে এর নিচে শেমিজ এবং Cherry on the top এর মতো ওড়না গায়ে দিয়ে আমাকে বের হতে হয়। আমি সাজতে পছন্দ করি, তবু আমার মনে হয় ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে বের হতে পারলে জীবন অনেক সহজ হয়ে যেত।

সবচেয়ে ভালো কথা হচ্ছে, এরকম পোশাকে অনেক মেয়েই এখন বের হচ্ছে। আমার বন্ধু বা পরিচিতও আছেন এর মধ্যে। কিন্তু ওই যে, পরিবার, তাই মন চাইলেও আমি অন্তত পারছি না। 

ভাবলে অবাক লাগে, কয়েক বছর আগেও আমি ওড়না পরা দিয়ে ভালো মেয়ে মন্দ মেয়ে বিচার করতাম। কারও অসাবধানতায় অন্তর্বাসের ফিতা দেখা গেলে অস্বস্তি বোধ করতাম। এসব নিয়ে গাল-গল্পে মশগুলও হতাম। আর সবার মতো আমিও হয়ত পোশাক দিয়ে মানুষকে বিচার করতাম।

শুধু কী তাই? কত মানুষের কত কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেদের সম্পর্ককে তিক্ত করেছি। কত মানুষকে ভুল বুঝেছি কিংবা অকারণ রিঅ্যাক্ট করেছি।

কিন্তু এখন আমি জানি, আমি আসলে কী চাই। পুরোপুরি ননজানমেন্টাল বলে নিজেকে দাবি করি না। কিন্তু চেষ্টায় আছি। আমি এখন জানি, ওড়না পরা না পরার সাথে মানুষের চরিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই, আমি এখন জানি মানুষ কতটা সৎ সেটা দিয়েই তাকে বিচার করা উচিত, আমি জানি প্রত্যেক সম্পর্কেরই কিছু সীমানা থাকে, সেগুলো মেনে চলতে হয়, আমি জানি সম্পর্ককে যত্ন করতে হয়, আবার এও জানি, কোনো সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয়।

আমি আস্তিক একজন মানুষ, আল্লাহকে বিশ্বাস করি। নামাজ পড়লে আমার মন শান্ত হয়। বিপদে আপদে দোয়া ইউনূস পড়ি, রোজ রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগীরা পড়ি শতবার, শবে বরাত বা শবে কদরেও নিয়ম করে নামাজ পড়ি। আবার একইসাথে আমি সমঅধিকারেও বিশ্বাস করি। আমি বিজ্ঞানে আর যুক্তিতে বিশ্বাস করি। আমার অন্তর ভালোবাসায় পূর্ণ, অকারণ ঝগড়া, কলহ, অন্যের পিছে লেগে থাকা এসবে আমি সময় নষ্ট করি না। সাধারণত কেউ আমাকে খোঁচা না দিলে আমি পাল্টা খোঁচা দিই না। আমি আমার মতো করে ধর্ম পালন করি, আমার মতো করে জীবন যাপন করি। কাউকে আমি আমার মতো হতেও বলি না, কারও মতো হতেও চাই না। 

বয়সের সাথে আমার ভাবনা চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। ফলে আগে যাদের সাথে যে গল্প করে আনন্দ পেতাম, এখন সেগুলোতে অস্বস্তি হয়। এখন আমি অনেক বেশি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

তবে এটাও ঠিক যে, পুরোপুরি নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট এখনো হয়ে উঠতে পারিনি। তবে আমার চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমার ছেলেকে ফেমিনিস্ট হিসেবে গড়তে নিজেকে এখনও অনেক ভাঙতে হবে। তাই আমি ওকে কাঁদতে দিই, কখনো বলি না যে ছেলেরা কাঁদে না। আমি ওকে হিংসার গল্প বলি না, ওকে ভালোবাসার গান শোনাই। যেন বড় হয়ে দুনিয়াটা ভালোবাসার চোখ দিয়ে সে দেখতে পারে। তখন আমি বাঁচি বা না বাঁচি, আমার দেওয়া বোধটুকু যেন ওর জীবনে রয়ে যায়।

আর সেই সময়, আমাদের মেয়েরা ইচ্ছামতো পোশাকে ঘর থেকে বের হবে, আমার ছেলেরা তাদের আলাদা করে দেখবে না, গলায় ওড়না আছে কি নেই তা নিয়ে গল্প ফাঁদবে না, কোনো মেয়ের শরীরে অনাকাঙ্খিত ছোঁয়া দেবে না। বছর ৩৬ এর স্বাধীন চিন্তার এই সাধারণ মা এমন প্রত্যাশা করতেই পারে, তাই না?