লবন বা চিনির মতো ভালোবাসা

জানতে হবে | ১ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, ৯:৩৫ ...

আমি উজানের খাবারে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত চিনি বা লবণ ব্যবহার করি নাই। এটা নিয়ে অনেকেই নানা রকম কথা বলেছেন, অনেকে নিজেদের সন্তান লালন পালনের উদাহরণ দেন, এমনকি কোনো চিকিৎসকও আমাকে চিনি-লবণ খাওয়াতে মানা করেননি।

বাচ্চা হওয়ার আগে থেকেই টুকটাক পড়াশোনা, গুগল ঘাঁটাঘাঁটি, ভার্চুয়াল জগতে থাকা মায়েদের অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিই যে অন্তত প্রথম এক বছর আমি উজানকে লবণ-চিনি কোনোটাই খাওয়াবো না। আর তাছাড়া এই দুইটা এমন কোনো সুপারফুড না যে তা না খাওয়ালে আমার বাচ্চা বাড়বে না।

অনেক নতুন মা-বাবা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন কেন আমার এই সিদ্ধান্ত। তাঁদের জন্য এখন কিছু তত্ত্ব কথা বলবো। যদি কারো কাজে লাগে ভালো লাগবে। আর যারা আমার সিদ্ধান্তে বাঁকা হাসি হেসেছেন তারাও হয়তো কিছু জানতে পারবেন।

উজানকে লবণ দিই না এটা জেনে অনেকেই আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছেন যে, আমি যেন ডাইনি মা, বাচ্চাকে বাজে স্বাদের খাবার গেলাচ্ছি। এটা ঠিক যে আমরা ছোটবেলা থেকে লবণ-চিনি খেয়ে বড় হয়েছি। কিন্তু তখন আমার আম্মু জানতো না যে এটা ক্ষতিকর। জানলে নিশ্চয়ই খাওয়াতো না। তাহলে আমি যখন জানতে পেরেছি, তখন কেন খাওয়াবো?

যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) (http://bit.ly/2n2x27g) বলছে, জন্মের পর থেকে ১২ মাস পর্যন্ত একটি শিশুর জন্য প্রতিদিন এক গ্রামের কম লবণ বা ০.৪ গ্রামের কম সোডিয়াম প্রয়োজন হয়।

যে বাচ্চারা মায়ের বুকের দুধ খায় তারা সেখান থেকেই শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সোডিয়াম বা লবণ পেয়ে যায়। আর যারা আমার ছেলের মতো ফর্মুলা বা কৌটার দুধ খায় তাদের জন্যও ওই দুধে প্রয়োজনীয় পরিমান লবণ বা সোডিয়াম থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো, পাঁচ, সাড়ে পাঁচ বা ছয় মাস পর যখন আপনি আপনার বাচ্চাকে দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার বিশেষ করে খিচুড়ি দিতে শুরু করবেন তখন কি তাকে লবণ ছাড়া বিস্বাদ খাবার দেবেন?

উত্তরটা খুব সোজা, কিন্তু কিছুটা ট্রিকি।

আপনার বাচ্চা কী লবণ চেনে? সে কি আপনার পেটের মধ্যে লবণ দিয়ে ঘি দিয়ে মজা করে ভাত মেখে খেত? সে কি পোলাও-বিরিয়ানি খেত?

এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না হয়, তাহলে উত্তরটা আপনি পেয়ে গেছেন। আপনি বাচ্চাকে যে স্বাদ চেনাবেন, সে সেই স্বাদটাই চিনবে। তার টেস্টবাড থাকবে সাদা কাগজের মতো। আপনি যে রঙে রাঙাবেন সেই রঙেই রঙিন হবে। অর্থাৎ, সে তো জানে না যে লবণ খেতে কেমন, সে তো জানে না যে লবণ ছাড়া খিচুড়ি খাওয়া যায় না, সে তো জানে না যে সুজি চিনি দিয়ে রান্না করতে হয়। ফলে আপনি যেভাবে খাবার অভ্যাস তৈরি করবেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে সেভাবেই অভ্যস্ত হবে।

লবন:

এবার আবার চোখ ফেরাই এনএইচএস এর পর্দায়। সংস্থাটি বলছে, ছোট শিশুদের খাবারে বাড়তি লবণ দেওয়া হলে তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না শিশুর কিডনি। সেইসঙ্গে শিশুদের বাজারের কেনা এমন সব খাবারও মুখে দিতে নিষেধ করা হচ্ছে যেগুলো তাদের জন্য বিশেষায়িতভাবে তৈরি না। কারণ সেগুলোতে থাকা উচ্চমাত্রার লবণ শিশুর কিডনীর ক্ষতি করতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ছোটবেলা থেকেই অতিরিক্ত লবণ খেয়ে অভ্যস্ত শিশুরা বড় হওয়ার পরও ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারে না। এরা আলাদা করে কোনো ফল বা সবজির স্বাদ বুঝতে পারে না। অতিরিক্ত লবণ বাচ্চার কিডনীর ওপর চাপ দেয়, যে চাপ বহন করার ক্ষমতা ওইটুকু শিশুর কিডনীর থাকে না।

আরো ভয়ানক কথা হলো, খাবারের মাধ্যমে অনেক বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করলে তা রেচন প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম হিসেবে বের হয়ে কিডনীতে পাথর সৃষ্টি করতে পারে। আর কিডনীতে পাথর যার হয় তিনিই জানেন এর যন্ত্রণা। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না শুধু স্বাদ বাড়ানোর জন্য বাচ্চাকে সেই যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে।

বাম্পস এন বেবি ওয়েবসাইট (http://bit.ly/2mZrgU3) বলছে, ছোটবেলা থেকে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে বড় হয়ে হাইপারটেনশনের রোগি হতে পারেন যে কেউ। এছাড়া বাড়তি লবণ শরীরে পানিশূণ্যতাও তৈরি করে। কারণ পানির তৃষ্ণা পেলে বাচ্চারা সেটা বলতে পারে না, যখন বিষয়টা বোঝা যায় তখন হয়ত অনেক দেরি হয়ে যায়।

বাড়তি লবণ অস্টেওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় সংক্রান্ত অসুখেরও কারণ।

চিনি:

এক মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত একটা বাচ্চার শরীরে রোজ ৬০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন হয়। সাত থেকে ১২ মাসের জন্য এই মাত্রা ৯৫ গ্রাম।

এই পরিমাণ শর্করার জন্য বিশুদ্ধ চিনি খাওয়ার দরকার পড়ে না। বাচ্চা রোজ যে হোল গ্রেইন খাবার খায়, ফল খায়, সবজি খায়, দুধ বা দুধজাত খাবার খায় সেখান থেকেই এই পরিমান শর্করা সে পেয়ে যায়। এজন্য চামুচে করে আলাদা চিনি খাওয়ার দরকার পড়ে না। বরং সুজি বা পায়েস রান্না করে অতিরিক্ত চিনি খাওয়ালে সেটা তার রোজকারের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়ে পড়ে। যার ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওবেসিটি, ডায়াবেটিক, দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া, হাইপার অ্যাকটিভিটির মতো সমস্যা দেখা দিতে থাকে।

এখন বলতে পারেন যে সুজি, ওটস বা সেরেলাক মিষ্টি ছাড়া কীভাবে খাওয়াবেন?

সেক্ষেত্রে চিনি ছাড়াও অনেক অপশন আছে। খেজুর দিয়ে সিরাপ তৈরি করে আট মাসের পর বাচ্চার খাবারে সেটা মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। এর আগে কলা, আপেল বা যে কোনো মিষ্টি ফলের পিউরি করে খাওয়াতে পারেন। সেই পিউরি সুজি বা সেরেলাক বা সাগুদানার সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন।

আর হ্যাঁ, এক বছরের আগে বাচ্চাকে অবশ্যই মধু দেওয়া যাবে না। এক ফোঁটাও না। কেন? একটু কষ্ট করে গুগল করে নেন।

নোট : প্রতিটা বাচ্চা আলাদা, কে কীভাবে কোন খাবারে রিঅ্যাকশন করবে সেটা আসলে আগে থেকে বলা যায় না। তবে যেহেতু বাচ্চারা শুরুতে কোনো স্বাদই চেনে না সেহেতু তাদেরকে কীভাবে কোন খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করবেন সেটা একমাত্র তার মা-বাবা-কেয়ারগিভাররাই ঠিক করতে পারেন। আমার বাচ্চা ডেট সিরাপ দিয়ে ওটস বা সাগুদানা সেদ্ধ খায়, সেজন্য আপনার বাচ্চাও সেটা পছন্দ করবে এমন কোনো কথা নেই। আবার আমি যেটা করি সেটাকেই ইউনিভার্সাল ট্রুথ বলে মনে করারও কোনো কারণ নেই।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : আমি চিকিৎসক নই, পুষ্টিবিদও নই। স্রেফ নিজের বাচ্চার জন্য সুস্থতার জন্য টুকটাক পড়াশোনা করে যা পেয়েছি সেগুলোকেই একটু গুছিয়ে সহজ করে লেখার চেষ্টা করেছি। কেউ যদি এত সামান্য উপকৃতও হন সেটাই হবে বিরাট পাওয়া।

পুরোটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জগতের সব বাচ্চার জন্য ভালোবাসা।

...
জানতে হবে | ৩০ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৬:৫৮

ফিডার পরিস্কার