বাংলাদেশের অন্য ১০টা মেয়ে যে বয়সে বিয়ে করে, তার চেয়ে কিছুটা দেরিতেই বিয়ে করেছিলাম আমি। ফলে একদম শুরু থেকেই বাচ্চা নিয়ে নেওয়ার একটা তাড়া ছিল পরিবারের। একে তো মোটা, তার ওপর বয়স বেশি (২৯), এখন বাচ্চা না নিলে পরে আর হবে না! এমন একটা ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল মনের মধ্যে।
আমি যে খুব বাচ্চা পছন্দ করতাম বা বাচ্চা না হলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে বলে ভাবতাম, বিষয়টা তা না। পরে চিন্তা করে দেখেছি, আসলে সবার কথা শুনতে শুনতে নিজের ভেতরেও বিষয়টা গেঁথে গিয়েছিল।
বিয়ের পর দুই বছরেও যখন কিছু হলো না তখন আবার সবার তাগাদাতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হলো। এই টেস্ট সেই টেস্ট করা হলো। গুচ্ছের টাকা গেল। নাভির কাছে কি সব ইনজেকশন দেওয়া হলো। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না।
তখন চিকিৎসক জানালেন, আমাদের দুজনের কোনো সমস্যা নেই। তবে আরও ছয়মাস স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করতে হবে। যদি কিছু না হয় তখন পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা শুরু হবে।
পরবর্তী ধাপ মানে আরও খরচ। আমরা তখন মাসের সব খরচ, সামাজিকতা সামলাতেই হিমশিম খাই। সেজন্য তখনকার জন্য পরবর্তী ধাপের চিকিৎসার কথা ভুলে থাকলাম।
এরমধ্যে ওজনটাও বেড়ে যাচ্ছিলো। কী মনে করে কঠিন ডায়েট শুরু করলাম। কার্বোহাইড্রেট খাই না, চিনি, ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড একদম বাদ। রোজ বিকেলে কারওয়ান বাজার থেকে বাসায় হেঁটে যাই। কয়েক মাসেই ১৪ কেজি কমিয়ে ফেললাম।
২০১৬ সালের সম্ভবত জুন মাসের কথা। রমজান চলে তখন। আমার বড় ফুফু পা ভেঙে হাসপাতালে। অফিস শেষে হাসপাতালে যাই, উনাকে দেখে বাসায় ফিরি। তো তখন যেহেতু আমি ভাজাপোড়া খাই না, সেহেতু ইফতারের জন্য কেটে আনা এক আইসক্রিমের বক্সভর্তি আনারস মাখা আমার হাতে দিয়ে মুক্তি আপু বললেন, ‘তুই যেহেতু কিছুই খাবি না, তাহলে এটা খা। ফলে তো কোনো সমস্যা নেই।’
আমিও বেশ মজা করে এক বক্স আনারস খেয়ে ফেললাম।
আমরা মাঝে মাঝেই ইনসট্যান্ট প্রেগন্যান্সি কিট দিয়ে টেস্ট করে দেখতাম। আনারস খেয়ে আসার পরদিন সকালেও কী মনে করে টেস্ট করলাম। অফিসের জন্য দুজনেই রেডি হচ্ছিলাম, ওই তাড়াহুড়ার মধ্যেই কেন যে টেস্ট করলাম নিজেও জানি না।
ওমা! দেখি কিটের দুটো দাগই গোলাপি হয়ে গেছে।
সেই প্রথম বুঝলাম, একটা শিশুর জন্য কতটা অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সেই প্রথম জানলাম, এই আনন্দ আসলে কেমন হতে পারে।
যাই হোক, তখনই কাউকে বলিনি। কেবল আমার ছোট বোন ওয়ারাকে জানাই। বলি দোয়া করতে। আর বলি, বিকেলে কোনো একটা ল্যাবে ইউরিন টেস্ট করতে দিয়ে আসবো।
গর্ভাবস্থায় আনারস খাওয়া নিষেধ, ওদিকে আমি এক বক্স আনারস খেয়ে বসে আছি। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসে। আমার হাঁটতেও ভয় হয়। মনে হয় হাঁটলেই বুঝি দুই পা বেয়ে নেমে আসবে লাল রক্তের ধারা, মনে হয় একটু হাঁটলেই বুঝি হারিয়ে ফেলবো আমার সন্তানকে। কেন আনারস খেলাম এতোগুলো সেই টেনশনে নীল হয়ে থাকি আমি। কোনোভাবেই মাথা থেকে আনারসকে ফেলতে পারি না।
সেদিন আমি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় অফিস যাই। কিন্তু মনে হয় ঝাঁকি বেশি লাগছে। আমি আমার ভেতরের ছোট্ট মাংস পিণ্ডটাকে বলি, বাবাসোনা, ভয় পেও না। কিচ্ছু হবে না।
কীভাবে যে অফিস শেষ করি জানি না। মাথার মধ্যে শুধু আনারস ঘোরে। বিকেলে ফুফুকে দেখতে যাওয়ার কথা। তিনি তখন ছিলেন শ্যামলীর ট্রমা সেন্টারে। পাশেই পপুলার ডায়াগনস্টিক। ঠিক করলাম পপুলারে টেস্ট করতে দিয়ে ট্রমায় যাবো।
কিন্তু সেই বিকেলে কারওয়ান বাজারে কোনো সিএনজি পাই না, না পাই বাস। আস্তে আস্তে হেঁটে আসি খামারবাড়ি পর্যন্ত। মাথায় কিন্তু তখনো কেবল আনারস। এরপর একটা রিকশা নিই, রিকশাওয়ালাকে যত বলি আস্তে চালান, উনি তত জোরে চালায়। কোনোমতে শিশু হাসপাতালের সামনে নেমে পড়ি। দুরুদুরু বুকে ঢুকি পপুলারে। বলি, প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাবো, সেল্ফ।
টেস্ট করতে দিয়ে ট্রমা সেন্টারে যাই। সবাই কত কথা বলে, আমি মনোযোগ দিতে পারি না। আমার মন পড়ে থাকে পপুলারের একটা ইউরিন ভর্তি কাঁচের বোতলে।
বড়ফুফুকে দেখে রাতে যাই মোহাম্মদপুরে বড় ননদের বাসায়। এর মধ্যে সুজন রিপোর্ট আনতে যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে রিপোর্ট পজেটিভ আসে। এরপর সবাইকে জানানোর পালা, আপুকে এক রুমে ডেকে সুজন জানায়। আপু জানান দুলাভাই আর মেজভাবীকে। আপুদের বাসার ড্রয়িংরুমে বসে চলে আলাপ, কি করতে পারবো, কি পারবো না, কি খাবো, কি খাবো না এসবের পরামর্শ শুনি।
রাতে বাসায় ফিরে আম্মু-আব্বুকে জানাই, যথারীতি আম্মু কান্নাকাটি করে খুশির খবর শোনে। তখন ঠিক হয় আপাতত তিন মাস না কাটলে কাউকে জানানো হবে না। শুধু দুই পরিবারের লোকেরাই জানবেন। কারণ, একে আমি মোটা, তারওপর বয়স তখন ৩২।
এভাবে নানা নিয়মকানুন মেনে শুরু হলো আমার জীবনের উজান যাত্রা। পুরো নয় মাস ঘটনায় পরিপূর্ণ ছিল। সবারই নিশ্চয় থাকে। তবে আমার এই যাত্রা আমি লিখে রাখবো উজানের জন্য। আমার সেই ছোট্ট মাংস পিণ্ডটা বড় হয়ে জানবে কেমন ছিল তার মা-বাবার জীবন। কেমন ছিল তাদের সময়গুলো। যদি আমার মতো Emotional Fool হয়, তাহলে ২০/২৫ বছর পরও এই লেখা পড়ে ওর চোখ জ্বালা করবে, গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে থাকবে।
এসব যদি হয়, তাহলে বুঝবো, আমার ছেলে কিছুটা হলেও মানুষ হয়েছে।