আমার দুই পরিবারের আকাঙক্ষার ফসল তখন আমার ভেতরে। ছোট্ট একটা প্রাণ, না ঠিক না প্রাণ না তখনও, কেবল একটা ভ্রুণ। প্রাথমিক পরীক্ষায় নিশ্চিত তো হওয়া গেছে, এখন জানতে তো হবে যে ভ্রুণটার বয়স কত। আমার পিরিয়ড সবসময়ই অনিয়মিত। তাই ভ্রুণের বয়স আন্দাজ করা আমার জন্য বেশ কষ্টের।
মেজভাবী বললেন, ডা. হুমায়রার কাছে আলট্রাসাউন্ড করাতে। যদিও তার সিরিয়াল পাওয়া বেশ কষ্টের। তবু সেটা জোগাড় করা হলো। নির্দিষ্ট সময়ে গেলাম আলট্রাসাউন্ড করাতে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক কাহিনী। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তার ঠিক নেই। যাই হোক, দুরু দুরু বুকে যখন নির্ধারিত বিছানায় শুয়ে পড়েছি তখনও ভীষণ উত্তেজিত আমি। কত বড় হলো আমার ছানাটা?
আমাকে চূড়ান্ত হতাশ করে দিয়ে চিকিৎসক জানালেন, আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষার ভ্রুণটার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না!
মানে?
বুঝতে পারেন আমাদের অবস্থা। সামান্য ব্লিডিংও হয়নি আমার, কিন্তু আমার ভেতরে যেটাকে আমরা প্রাণ ভাবছিলাম, তার সেই প্রাণের স্পন্দনই পাওয়া যাচ্ছে না। একজন মায়ের, একজন বাবার তখন কেমন লাগতে পারে? যার নাম ভাবতে শুরু করেছি, সে নিজেই যদি স্বপ্ন হয়ে যায় তাহলে কেমন লাগতে পারে?
আমার গাইনাক বললেন, আগামী দুই সপ্তাহ একদম নড়াচড়া করা যাবে না। পুরোপুরি বেড রেস্ট, অফিস যাওয়া, জার্নি, বেড়ানো সব বন্ধ।
সেদিন যে কীভাবে বাসায় এসেছিলাম মনে নেই। শুধু মনে আছে এনটিভি অনলাইনের নিউজ এডিটর রফিকুল রঞ্জু ভাইকে ফোন করে বলেছিলাম, ‘ভাই আমি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু এখন ডাক্তার বলছে আমার ফিটাসের হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। দুই সপ্তাহ রেস্টে থাকতে হবে। আমি দুই সপ্তাহ পর সব ঠিক থাকলে অফিসে আসেবা।’
রঞ্জু ভাই অনুমতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনি রেস্টে থাকেন, আমি অফিসে কথা বলে নিচ্ছি।’
এবার শুরু হলো আমার খাওয়া আর বিশ্রামের দিন। এতো বিশ্রাম মনে হয় জ্ঞান হওয়ার পরে আর নিইনি। আর এতো ভয়ের জীবনও কাটাইনি। সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা যেন আর গড়ায় না। মাত্র দুই সপ্তাহ আর শেষ হয় না। আমি সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকি, নামাজ পড়ি, দোয়া পড়ি, মাঝে মাঝে বসে গল্পের বই পড়ি, সেলাই করি। এর মধ্যে আম্মার একটা শাড়িতে হাতের কাজ করে ফেললাম। কিন্তু সময় শেষ হয় না।
আস্তে আস্তে হাঁটি, ভয়ে ভয়ে বাথরুমে যাই। ঘুমালে স্বপ্ন দেখি যে ব্লিডিং হয়ে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ি। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, নামাজের মধ্যেও সূরার বদলে আয়াতুল কুরসি পড়ে ফেলেছি। মনে হতো এক আয়াতুল কুরসিই বাঁচাতে পারবে আমার রক্তের বিন্দুটাকে। সে যে কী ভয়াবহ দিন।
দুই সপ্তাহ পরে আমরা গেলাম আম্মুর চাচাতো বোন রুমা খালামনির চেম্বারে। যিনি আলট্রাসাউন্ড স্পেশালিস্ট, তিনি খুব ভালো করে দেখলেন এবং বললেন, হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে, একদম স্পষ্ট। কোনো সমস্যা নেই, বাচ্চা ভালো আছে।
এই খবর যে কতটা স্বস্তির ছিল সেইটা এখন এই তিন বছর পর এসে বোঝানো যাবে না। এইটা শুধু আমার পরিবারের লোকেরা জানে।
যখন সব ঠিক আছে তখন অফিস করতে তো বাধা নেই। তবে ডাক্তার বলে দিলেন, সাবধানে থাকতে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে।
শুরু হলো আমাদের অপেক্ষার পালা।
প্রথম দিন অফিসে গেলাম সিএনজিতে। চালককে যত বলি সাবধানে চালাবেন, উনি তত বেপরোয়া চালায়। কী যে আতঙ্ক লাগে। মনে হয় এই বুঝি কোনো বাস এসে সিএনজিকে মেরে দিল। কিংবা সিএনজি বুঝি উল্টে গেল। এতো ঝাঁকি লাগে! আবার রোজ সিএনজিতে যাবো সেই সামর্থও তো নেই।
কয়েকদিন পর বাসে উঠতে শুরু করলাম সাহস করে। শুধু খেয়াল রাখতাম যেন চলন্ত বাসে না উঠি। পুরো ৯ মাস মোটামুটি দাঁড়িয়েই অফিস গেছি। কারণ শ্যাওড়াপাড়া থেকে সিট পাওয়া কঠিন। ফার্মগেটে গিয়ে কিছুটা খালি হলে তখন পাওয়া যায়। আর আমি তো কারওয়ানাজার নেমেই যাই।
সেই বাসে উঠেও যে কত কাহিনী হতো। ভিড়ের বাসে লোকজনের জন্য চেপে দাঁড়াতে হয়। এদিকে আমি তো পেটে চাপ লাগাবো না কিছুতেই। কত টেকনিক করে করে যে দাঁড়াতে হতো!
রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম যে পেটটা একটু বড় হলো কি না। কারণ, আমার সাধারণ গর্ভবতীদের যেসব লক্ষণ দেখা যায় তার কিছুই ছিল না। বমি হয়নি, বমি পেতও না! মাথা ঘোরেনি, মুখে অরুচি ছিল না। কেবল ইলিশ আর চিংড়ি পোকা ছাড়া অন্য মাছ খেতে ভালো লাগতো না। তাই জোর করে খেতাম না। আর সবকিছুতেই মাশ’আল্লাহ রুচি ছিল। আর তাই ৮৪ কেজি ওজন নিয়ে কনসিভ করা আমার ওজন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০২ কেজিতে। এর মধ্যে উজানে ওজন ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯ কেজি। আর বাকি পুরোটাই আমি।
তো, শুরু হলো আমার দীর্ঘ গর্ভকালীন সময়ের যাত্রা। এই ঢাকা শহরে একজন অন্তসত্ত্বা, মধ্যবিত্ত, কর্মজীবী নারীর দিনগুলো কেমন গিয়েছে সেইটা জানতে পড়তে হবে পরের পর্ব। আবার কবে সেই পর্ব লেখার সময় পাবো সেইটা অবশ্য জানি না।
এই সিরিজের প্রথম পর্ব: উজান যাত্রা